এক নজরে

বাংলার মিষ্টান্ন তালিকায় সেরা বেলাকোবার চমচম

By admin

October 28, 2021

তপন মল্লিক চৌধুরী

উনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে পোড়াবাড়িতে প্রথম চমচম তৈরি শুরু হয়। দশরথ গৌড়ের চমচমের সঙ্গে ছিলেন রাজারাম গৌড়, নারায়ণ কোকন হালুই, মোদন গৌড়, শিব শংকর ও কুশাই দেব। ত্রিশ দশকের শেষের দিকে আসামের রামেন্দ্র ঠাকুর, তীর্থবাসী ঠাকুর টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকে পাঁচআনী বাজার মিষ্টিপট্টি নামে পরিচিতি হয়। তখন পোড়াবাড়ি টাঙ্গাইলের অন্যতম নদী বন্দর ছিল।পোড়াবাড়ি ঘাটে যমুনা থেকে আসা বড় বড় নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার ভিড়তো। নানা ধরনের লোকজনের আনাগোনার ছিল সেই ঘাটে। রাজা-বাদশাথেকে সাধারণ মানুষ সবারই পোড়াবাড়ির চমচমের প্রতি ছিল আকর্ষণ।

চমচমের বাইরেরটা দেখতে পোড়া ইটের মতো আর ভিতরের অংশ রসালো ও নরম।সুস্বাদু এই চমচমের উপরিভাগে ছড়ানো চিনির গুড়ো মুখে এনে দেয় কড়া মিষ্টির স্বাদ।টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের স্বাদ আর স্বাতন্ত্রে জুড়ি মেলাভার। পোড়াবাড়ির চমচমের রয়েছে প্রায় দু’শো বছরের ইতিহাস। কথিত টাঙ্গাইলের বাইরে গিয়ে এমন সুস্বাদু ও নরম চমচম তৈরি সম্ভব নয়। ধলেশ্বরী নদির জল আর তার পারের সবুজ ঘাস খেয়ে দেশি গরু যে খাঁটি দুধ সরবরাহ করে সেটাই হল চমচম তৈরির প্রধান উপকরণ। আর চমচম বানাতে লাগে দুধ আর চিনি। প্রবীণ কারিগরদের অনেকেই বলেন, ধলেশ্বরীর জল ছাড়া এমন চমচম তৈরি সম্ভব নয়।

ব্রিটিশ আমলে সন্তোষের জমিদারদের এক মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল কলকাতায়। সেই অনুষ্ঠানের অতিথিদের পোড়াবাড়ির চমচম খাওয়ানোর কথা ভাবলেন জমিদার। তিনি পোড়াবাড়ি থেকে কয়েকজন নামি কারিগর নিয়ে গেলেন কলকাতায়। কয়েক দিন চেষ্টা করেও তাঁরা সুস্বাদু চমচম তৈরি করতে পারলেন না। কারণ খুঁজতে গিয়ে ধলেশ্বরীর জলের কথাই এলো আগে।পোড়াবাড়ি হলো ছোট্ট একটি গ্রামের নাম। টাঙ্গাইল শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরের পথ। ছোট্ট শান্ত এই গ্রামকে ঘিরেই চমচমের সৃষ্টি। পোড়াবাড়ি বাজার থেকে একটু পশ্চিমেই ধলেশ্বরী নদী। এটি যমুনার একটি শাখা।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের বলি হয়ে পূর্ব বাংলার টাঙ্গাইল থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে আশ্রয় নেয় বেশ কিছু ছিন্নমূল মিষ্টান্ন কারিগরেরা। টাঙ্গাইল পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের বসতি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গের বেলাকোবায় চলে আসেন দুই বন্ধু ধীরেন সরকার ও কালিদাস দত্ত।ওই দুই মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীর হাত ধরে বেলাকোবার চমচমের পথ চলা শুরু হয়। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের রহস্যময় রেসিপি এই দুই টাঙ্গাইলবাসীর হাত ধরে বেলাকোবা পাড়ি দেয় এবং কালক্রমে চিরাচরিত ঘরানা ছেড়ে নতুন ভাবে বেলাকোবার চমচম রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

পোড়াবাড়ি ছেড়ে বেলাকোবা যেমন তাঁদের নতুন ঠিকানা হল তেমনই চমচমেও  এল খানিক নিজস্ব ছোঁয়া। যা আগে হত ছানা-ময়দা-চিনি দিয়ে এবার নতুন চমচমে যোগ হল খোয়া ক্ষীর, একটু বেশি পরিমাণেই। তাতে চমচমের স্বাদের মাত্রাও গেল বেড়ে। একদম শেষে, চমচমের উপরে দেওয়া হল ক্ষীরের আস্তরণ।এইভাবে বাঙালির পাতে বেলাকোবার চমচম হাজির হল একদম নতুন স্বাদে। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে সময় বেশি লাগলো না। এখনো একইভাবে হয় চমচম। না গরম না ঠান্ডা এমন অবস্থায় মাখতে হয় ছানা। তবে হতে হবে খাঁটি দুধের ছানা। তারপর সারারাত কড়া পাকের রসে চুবিয়ে রাখা হয়। তবেই না সে হবে বেলাকোবার ঐতিহ্যবাহী চমচম! প্রায় সারাবছরই দেশ-বিদেশ থেকে অর্ডার আসতে থাকে দোকানগুলিতে। এখানকার বেশিরভাগ দোকানের বাইরেই লেখা “এখানে বেলাকোবার চমচম পাওয়া যায়।” বাজারে বেলাকোবার চমচমের চাহিদাওযথেষ্ট।

২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিকারপুর, বোদাগঞ্জ,গজলডোবাকে কেন্দ্র করে নতুন পর্যটনস্থান গড়ে তুলেছিল। তার মধ্যমণিই ছিল বেলাকোবার চমচম। তবে এখানকার স্থানীয় মিষ্টি প্রস্তুতকারকদের দীর্ঘদিনের আবেদন,কলকাতার রসগোল্লার মতো বেলাকোবার চমচমকেও দেওয়া হোক জিওগ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ। সেটা হয়ত একদিন হবে। কিন্তু যতদিন না হচ্ছে স্বাদ তাতে কমছে না। বরং পোড়াবাড়ির চমচমের ঘরানার সঙ্গে বেলাকোবার চমচমের ঘরানার কতকগুলি মৌলিক পার্থক্য থেকেই যায়। পোড়াবাড়ির চমচমের বৈশিষ্ট হলো কড়াপাক। কিন্তু, বেলাকোবায় চমচমে কড়াপাকের সঙ্গে যোগ হয়েছে বেশি পরিমাণে ক্ষীর। পেল্লাই আকারের গোলাপি চমচমে বরফের কুচির মত ছড়ানো থাকে ক্ষীরের দানা।