এক নজরে

চকলেটের হাসি চকলেটের কান্না

By admin

January 10, 2022

চকোলেট তৈরির জন্য কাঁচামাল হিসাবে দরকার হয় কোকোয়া বীজ। উন্নত দেশগুলিতে যে চকোলেট তৈরি হয় তার প্রধান কাঁচামাল কোকোয়া বীজের ৬০ শতাংশই যোগান দেয়আইভরি কোস্ট আর ঘানা; পশ্চিম আফ্রিকার দুই দেশ। এর মধ্যে আইভরি কোস্ট একাইযোগান দেয় দুনিয়ার চল্লিশ ভাগ কোকোয়া। দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশেরও বেশি আসে কোকোয়া রপ্তানি করে,যা দেশটির রপ্তানি আয়ের অর্ধেক।এই কোকোয়া উৎপাদন করতেআইভরি কোস্ট আর ঘানার ক্ষুদ্র চাষিদের যে কী পরিমাণ ঘাম ঝড়াতে হয় তা অন্য এক শোষন কাহিনি। যে কাহিনির মধ্যে লুকিয়ে আছে সুলভ শ্রমের জন্য চলতে থাকা শিশু পাচার, ভিন্ন ধরণের দাসত্ব প্রথা আর কোকোয়ারদাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যমধ্যসত্ত্বভোগী ক্ষমতাবান কোম্পানির চক্রান্ত।

কোকোয়া চাষ হয়শহর থেকে দূরেবনাঞ্চলের ছোট ছোট জমিতে। বহু কাল ধরেই এই কোকোয়া চাষ হচ্ছে কিন্তু চাষের পদ্ধতি এখনও আধুনিক হয়নি।কোকোয়া চাষে প্রচুর মানুষের শ্রম দরকার হয়। চাষের পর সঠিক সময়ে কোকোয়া ফল সংগ্রহ, ফল থেকে বীজকে আলাদা করে ফার্মেন্টেশন এবং তার পরে শুকিয়ে সেই বীজ বিক্রির জন্য প্রস্তুত করার পুরো কাজ কোকোয়া চাষিরা নিজেরাই করে। ফার্মেন্টেশনের ফলেই বীজের ভেতরে এনজাইম তৈরি হয় যা চকলেটের মিষ্টি গন্ধের জন্য খুব জরুরী।

কোকোয়া চাষের পদ্ধতি আধুনিক না হলেও তার চাহিদা দিন দিন বেড়েছে। পাশাপাশি দরকার হয়ে পড়েছে প্রচুর শ্রমিকের। ব্রিটিশ ডকুমেন্টারি ‘Slavery: A Global Investigation (2000)’–তে দেখানো হয়, ঘানা এবং আইভরি কোস্টে পাচার হয়ে আসা শিশুদের দাস হিসেবে কোকোয়া চাষে ব্যবহার করা হচ্ছে। দিনের পর দিন কোনো ধরনের বেতন ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য করছে সেই সব শিশুদের, কাজ না করলে তাদের ওপর শারিরীক নির্যাতন করা হয়। মধ্যসত্ত্বভোগী ক্ষমতাবান কোম্পানিগুলি কোকোয়ার দাম নিয়ন্ত্রণকরতে কোকোয়া চাষিদের বঞ্চিত করে। চাষিদের অবস্থা উভয়সঙ্কটে- এখানে বেশি কোকোয়া উৎপাদন করলেও দাম স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাবে আবার কম উৎপাদন করলে চাষিদের পেট চলবে না।মধ্যসত্ত্বভোগী ক্ষমতাবান কোম্পানিগুলির খপ্পরে চাষিরা বেশি কোকোয়া উৎপাদনের নেশায় আইভরি কোস্ট আর ঘানায় মাইলের পর মাইল সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস কর চলেছেন।

কোকোয়া চাষিরা প্রচুর পরিমাণে কোকোয়া চাষ করেও দিনের শেষে রোজগার করেন মাত্র এক ডলার।২০০০ সালেচকলেট কোম্পানি, বহু ক্রেতা, এনজিও এবং আরো অনেকেই দাবি তুলেছিল, আইভরি কোস্ট আর ঘানার কোকোয়া চাষকে২০০৫ সালের মধ্যেই দাসমুক্ত করতে না পারলে তাদের বয়কট করাহবে। কিন্তু তা হয়নি। আসলেবেশিরভাগ চকলেট কোম্পানি সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে কোকোয়া বীজ কেনে না। কোকোয়া বীজ সংগ্রহ আর প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাতের পুরো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে হাতে গোনা কয়েকটি শক্তিশালী কোম্পানি, যারা ‘কোকোয়া ট্রেডার’ নামেপরিচিত।

এখনো লক্ষ লক্ষ শিশু কিশোর সরাসরি কোকোয়া চাষের বিভিন্ন ধাপে জড়িত। পাশাপাশি সার্টিফিকেশনও কাজ করছে। সবই চলছে কোকোয়া বাজারের মারপ্যাঁচে।কোকোয়া বীজের চাষ করেনআইভরি কোস্ট আর ঘানার প্রত্যন্ত এলাকার বিচ্ছিন্ন চাষিরা। একটি কোকোয়া গাছ থেকে গড়ে এক কেজি বীজ পাওয়া যায়। একজন চাষি একটি মরসুমে গড়ে বিশ, ত্রিশ কিংবা চল্লিশ কেজি বীজের যোগান দিতে পারেন।কোকোয়ার দাম নির্ধারিত হয় লন্ডন কিংবা নিউ ইয়র্কের বাজারে। আইভরি কোস্ট আর ঘানা তাদের স্থানীয় চাষিদের জন্য আন্তর্জাতিক মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে ঠিক করে দেয় ‘ফার্ম গেইট প্রাইস’। কিন্তু যেহেতু চাষিদের সঙ্গে রপ্তানিকারকদের সরাসরি যোগাযোগের পরিকাঠামো নেই,তাই চাষ থেকে রপ্তানিকারক পর্যন্ত পৌঁছাতে সাত থেকে আটবার হাত বদল হয়।

প্রতিবছর সরকার ফার্মগেট মূল্য বেঁধে দেয়, কিন্তুতার থেকে অনেক কম দামেই চাষিরাকোকোয়াবিক্রি করেন। কোকোয়া ব্যবসার লাভের গুড় খায় মধ্যসত্ত্বভোগীরা। কারণ, তাদের হাতে রয়েছে গুদাম, পরিবহন ব্যবস্থা, প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সার্টিফিকেশন আদায়ের ক্ষমতা। অন্যদিকে কোকোয়া বীজ বিক্রি করে বেঁচে থাকার রসদ যোগাতে হিমশিম খায় চাষিরা।আইভরি কোস্ট আর ঘানার বেশিরভাগ এলাকাতেই নেই পানীয় জল, স্কুল কিংবা চিকিৎসা ব্যবস্থা। সব বাচ্চারাই তাই কোকোয়া চাষে জড়িয়ে পড়ে। আটকে যায় নিরক্ষরতার জালে। জীবন আর জীবিকার তাগিদে কোকোয়া চাষ করেও কোনওদিন একটা চকলেট হাতে ধরতে পারেনি এমন সংখ্যা বিরাট।