ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত কি ওই দুটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? প্রাণঘাতী হামলা পাল্টা হামলা চলছে প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো। এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে যে ছড়িয়ে পড়তে পারে সেই আশঙ্কা ক্রমশই ঘণিভূত হচ্ছে। আশঙ্কার কারণ, অঞ্চলটি বিশ্বের তেল ও গ্যাসের অন্যতম মূল উৎপাদনকেন্দ্র। ফলে আশঙ্কা স্বাভাবিক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও পশ্চিমের দেশগুলি রাশিয়ার তেল বাণিজ্যে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তার জেরে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছিল। মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল একইসঙ্গে। ফলে ফের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলে যুদ্ধ জোরদার হলে পরিস্থিতি কী হবে, তা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়। বস্তুত অর্থনৈতিক উৎপাদনের মূল জ্বালানি হচ্ছে তেল। ফলে তেলের দাম বাড়লে উৎপাদনের খরচও বাড়ে। আর তার প্রভাব শেষমেশ গিয়ে পড়ে ভোক্তার ওপর, বিশেষ করে খাদ্য, পোশাক ও রাসায়নিকের মতো জ্বালানি-নির্ভর পণ্যের উপর। ফলে ইসরায়েল-ইরান সংঘাত টানা চলতে থাকলে বিশ্বজুড়ে তেল আমদানিকারক দেশগুলি আবার চড়া মূল্যস্ফীতির মুখে পড়বে। তখন প্রবৃদ্ধির গতিতেও টান পড়তে পারে।
পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই বিশেষঙ্গরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলি তাদের নীতিগত স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করতে পারে। জি-সেভেনের ধনী দেশগুলির কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা ইতিমধ্যে সুদের হার কমানোর রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছে। ঠিক এই সময় জ্বালানির দামে যদি বড় ধরনের ধাক্কা লাগে তাহলে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ার কথা। ইসরায়েল-ইরান সংঘাত শুরু হওয়ার পর বিশ্ব বাজারে তেলের দাম ইতিমধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। সংঘাত পরিস্থিতি আরও তীব্র হলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেই আশঙ্কা। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। যদিও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফের ক্ষমতায় এসে প্রায় সব দেশের উপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করায় আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ এখনো সুদের হার কমায় নি। কিন্তু তেলের দাম যদি বাড়তে থাকলে তারা কী সেই পথে হাঁটবে না? এমনিতেই গত কয়েক বছরে প্রবৃদ্ধির গতি কমে গিয়েছে, তার মূল কারণ কিন্তু তেলের দামবৃদ্ধি। এখন ফের তেলের দাম বাড়লে পরিস্থিতির অবনিত ঘটবেই।
স্বাভাবিক কারনে সবারই নজর এখন হরমুজ প্রণালির দিকে। ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের মাঝখানে অবস্থিত এই জলপথ বিশ্ব তেল বাণিজ্যের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পথ। ইরান এর আগে বহুবার এই প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। যদি তারা তা করে তাহলে বহু তেলবাহী ট্যাংকার আটকা পড়বে আর তার জেরে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হবে। কারণ, প্রতিদিন বিশ্বে যে পরিমাণ তেল ব্যবহৃত হয়, তার প্রায় এক পঞ্চমাংশ বা ১৮ থেকে ১৯ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৯০ লক্ষ ব্যারেল তেল এই প্রণালি দিয়ে যাতায়াত করে। তেলের দামের সঙ্গে দুনিয়ার সমস্ত জিনিসের দাম জড়িয়ে আছে। অতএব তেলের দাম বাড়া মানেই বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া। ইসরায়েল-ইরান সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে চাপ আরও বাড়বে। বিশেষঙ্গরা বলেন, তেলের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে পরের এক বছরে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ০.৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ইরানঘনিষ্ঠ লেবাননের হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের হুতিরা এই সংঘাতে জড়িয়ে অড়লে পরিস্থিতির যে আরও অবনতি হবে সে কথা বলাই বাহুল্য। ওই অবস্থায় আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল ও পর্যটন ক্ষেত্র কার্যত অচল হয়ে পড়বে।
ইতিমধ্যে ইসরায়েল ও ইরান নিজেদের আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে। ইরাক ও জর্ডানও একই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইনস ওই অঞ্চলে উড়ান বাতিল করেছে। ইরানের পাল্টা হামলার আশঙ্কায় ইসরায়েলি বিমান সংস্থাগুলি তাদের কিছু উড়োজাহাজ তেল আবিবের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে। খবর অনুযায়ী, তেল আবিব থেকে বেশ কয়েকটি বিমান উড়ে গিয়েছে, এর মধ্যে কিছু বিমান যাত্রী ছাড়াই সাইপ্রাস ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিমান চলাচলের সময়সুচি বিঘ্নিত হবে, বিমানভাড়াও বাড়বে আর ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হবে। উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগে ইসরায়েল যখন ‘বিশেষ জরুরি অবস্থা’ জারি করে, ততক্ষণে দেশটির মুদ্রা শেকেলের প্রায় ২ শতাংশ দরপতন ঘটে গিয়েছে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মানুষ সুপারশপে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এমনকি এসব দোকানে পণ্যের তাকও খালি হয়ে যায়। সুপারমার্কেট চেইন ক্যারেফোরে ১ দিনেই ৩০০ শতাংশ ক্রেতা বেড়ে যায়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে শেয়ার সূচকের পতন হয়েছে। এী পরিস্থিতিতে মানুষ নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যমে হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকে পড়ে, হচ্ছেও তাই। সেী কারণে সোনার দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে অন্যান্য মুদ্রার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, এমন সময়ে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হল, যখন বিশ্ব বাজার এমনিতেই নানা ধরনের অনিশ্চয়তায় জর্জরিত। সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে। আমেরিকার আমদানির উপড় উচ্চহারে শুল্ক বসানোর হুমকি ইতিমধ্যে বিশ্ববাণিজ্যকে বিপর্যস্ত করেছে। বিনিয়োগকারীফের অধিকাংশই আস্থা হারিয়েছে। এর ফলে ভোক্তা ব্যয় ও ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়েছে।