ড. সুস্মিতা মিত্র
সহযোগী অধ্যাপক
কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, নয়া দিল্লি
ভারতের তথা বিশ্বের খুব কঠিন সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হল জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ (#Educationpolicy)। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের মনে ভিড় করছে হাজার প্রশ্ন, যে করোনা পরবর্তী ভারতীয় আর্থিক ব্যবস্থার মোকাবিলায় কতটা সহযোগী হবে এই নীতি? তবে শিক্ষাবিদদের ভাবনা আরও সুদূরপ্রসারী দিকগুলো নিয়ে। কারণ কোনো শিক্ষানীতিই খুব স্বল্প সময়ের জন্য তৈরি হয়না। মাঝে ১৯৯২ সালে কিছু ছোটখাটো পরিবর্তন বাদ দিলে ৩৪ বছর পর আমূল পরিবর্তন ঘটানো হল জাতীয় শিক্ষা নীতিতে। জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে ভালোয় মন্দয় মিশিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে বিতর্ক ইতিমধ্যেই তুঙ্গে। তবে এই লেখায় আমি শুধু আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে আনা একাধিক বিকল্প নীতির ভালো-মন্দের দিকগুলোকেই তুলে ধরতে চাই।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ অনুযায়ী, তিন বছরের বিএ এবং বিএসসি ডিগ্রি অপরিবর্তিত থাকলেও, একটি চার বছরের বহু-বিভাগীয় ব্যাচেলর প্রোগ্রাম চালু হতে চলেছে এবং যাতে যে কোনও সময় কোর্সে প্রস্থান এবং পুনরায় প্রবেশের বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে। যদি কোনও শিক্ষার্থী ১ বছর পরে প্রোগ্রামটি থেকে বের হতে বাধ্য হয়, সে একটি বৃত্তিমূলক শংসাপত্র পাবে।একইভাবে দ্বিতীয় বছরের জন্য থাকবে উন্নত ডিপ্লোমা। তৃতীয় বছর সম্পূর্ণ করলে পাওয়া যাবে স্নাতক ডিগ্রি এবং চতুর্থ বছর শেষে পাওয়া যাবে গবেষণার সাথে স্নাতক ডিগ্রি। চার বছরের আগে বেরিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে কোর্সটি পুনরায় শুরু করতে পারে। চার বছরের ডিগ্রি প্রোগ্রামের পরে, একজন শিক্ষার্থী সরাসরি এক বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি করতে পারে। তিন বছরের স্নাতক ডিগ্রি পরবর্তী মাস্টার্স ডিগ্রি অবশ্যই ২ বছরের। মাস্টার্স ডিগ্রির পরেই ছাত্রছাত্রীরা পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য এগিয়ে যেতে পারে, এমফিল প্রোগ্রামটি তুলে নেওয়া হয়েছে।
বহু-বিভাগীয় বা multidisciplinary শব্দটা আমার মনের খুব কাছের। মনে পরে, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়তে অর্থনীতি নিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করে গবেষণা শুরু করার আগে আমার সুপারভাইসারকে জানিয়েছিলাম আমার মনের কথা। নাটক আর অর্থনীতি দুটো বিষয় নিয়েই আমার ভালবাসা আর পড়ার ইচ্ছার কথা। ওনার পরামর্শ অনুযায়ী, আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করতে যেতে হত বিদেশে, কারন একমাত্র বিদেশেই সম্ভব ছিল তখন এরকম দুটো বহু-বিভাগীয় বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করা। নতুন শিক্ষানীতির ফলে যদি এই সুবিধা দেশেই পাওয়া যায়, তবে আমার বিশ্বাস আমার মত বহু ছাত্রছাত্রীর স্বপ্নপূরণ সম্ভব। এমফিল প্রোগ্রামটি তুলে নেওয়ার ফলে আমার মতে ছাত্রছাত্রীর এক থেকে দুই বছর সময় বেঁচে যাবে। আমি নিজে এমফিল এবং পিএইচডি করেছি এবং জানি যে দু’ বছর-র এমফিল না করতে হলে ত্রিশ বছর বয়েসের মধ্যেই পড়াশুনা শেষ করতে পারতাম।
একাধিক প্রস্থান বিকল্পও আমার মতে খুবই স্বাগত জানানোর মতো পদক্ষেপ। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়তে পিএইচডিতে এই রকম প্রস্থান বিকল্পের প্রচলন রয়েছে। আমার নিজের চেনা বহু জনের ক্ষেত্রে আমি হলফ করে বলতে পারি, এই বিকল্প না থাকলে পিএইচডি শেষ করার স্বপ্ন অপূর্ণ ই থেকে যেত তাঁদের। বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবার অনিশ্চয়তা এবং আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পরবর্তী বেশ কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে নতুন শিক্ষানীতি তাদের পরিবারের আয়ের কথা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে ফের পড়াশোনায় ফিরে আসার সুবিধা বা নমনীয়তা দিতে পারে। তবে এর একটা বিপরীত দিক ও রয়েছে। বিশেষত ছাত্রীদের ক্ষেত্রে। অনেক সময়ে মেয়েরা বিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে পারতো ডিগ্রি শেষ করার উদ্দেশ্যে। এমন অনেক মেয়েরাই হয়তো ভবিষ্যতে বৃত্তিমূলক শংসাপত্র বা উন্নত ডিপ্লোমা নিয়ে বিয়ে করে ফেলতে বাধ্য হবে।
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভয়ের জায়গা অন্য। নতুন শিক্ষানীতির ফলে বিশ্ববিদ্যালযের পরিভাষা আনেকটাই ব্যাপ্ত। ‘বিশ্ববিদ্যালয় বলে গণ্য’, ‘অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়’, ‘অনুমোদিত প্রযুক্তিগত বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ‘ইউনিটরি বিশ্ববিদ্যালয়’ সবই ভবিষ্যতে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে গণ্য হবে। এতে কোথাও মুড়ি-মুড়কি একই দর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। এর ফলে বেসরকারীকরণের দ্বার আরও উন্মুক্ত হওয়ার ভয়ও অমূলক নয়। বর্তমানে শিক্ষা ব্যাবস্থা যে ভাবে বেসরকারীকরণের দিকে ঝুঁকছে এবং ফলস্বরূপ বেড়ে যাচ্ছে পড়ার খরচ-খরচা, তাতে ক্রমশ উচ্চ শিক্ষা চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, এক বা দুই দশক পরে জন্মালে শুধু মাত্র খরচের কারনেই হয়ত যেখানে পৌঁছেছি সেখানে পৌঁছানো হতো না!