এক নজরে

অন্য দুর্গা অন্য পুজো

By admin

October 22, 2023

‘মারাং বুরু যাহা ইয়ুব মায়েন’। এই মন্ত্র বিশুদ্ধ সংস্কৃত নয়, দুর্গা পুজোরও নয়। কিন্তু সাঁওতালি ভাষার এই মন্ত্রোচারণের মধ্য দিয়েই বিগত দু’দশকের বেশি সময় ধরে নিয়ম ও নিষ্ঠাভরে দেবী দুর্গা পুজো হচ্ছে বাঁকুড়ার হীড়বাঁধের প্রত্যন্ত গ্রাম দোমোহানিতে। এখানে নেই কোনো থিমের ভাবনা, আলোর জৌলুসও যে থাকবে না সে কথাও বলা বাহুল্য। সারা বছর প্রতিমা রেখে নিত্য পুজো হলেও সপ্তমী থেকে দশমী নিয়ম মেনেই এখানে পুজো করেন জঙ্গল মহলের সরস্বতী দেবী। শারদীয়া দুর্গা পুজোর আগে পুরনো প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে নতুন প্রতিমা তৈরি হয়। আর প্রথম থেকেই সেই প্রতিমা তৈরী করে আসছেন পুরুলিয়ার ভুয়াকানা-কাশিডী গ্রামের সুনীল হেমব্রম দেবী। আদিবাসী সমাজে মূর্তি পুজোর প্রচলন নেই। ফলে দেবী দূর্গার মূর্তি তৈরী করে পুজোর বিরোধিতা করেছিলেন আদিবাসী সমাজের অনেকেই। বিষয়টি থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছিল।যদিও শুরুতে এই দুর্গা পুজো ছিল সরস্বতী দেবীর বাড়ির পুজো কিন্তু আদিবাসী সমাজ বাধা দিয়েছিল। এখন গ্রামের সবাই অপেক্ষা করে থাকেন বছরের এই চারটি দিনের জন্য। এখন আর হাঁসদা বাড়ির পুজো নয়, এইপুজো এখন সার্বজনীন। লক্ষ-কোটি টাকার থিমের চাকচিক্য কিংবা আলোর রোশনাই না থাকলেও শান্তি আর মিলনের এই পুজোয় চারদিন সব আনন্দ চেটে পুটে ভাগ করে নেন দোমোহানি গ্রামের মানুষ। বাঁকুড়া ছাড়িয়ে পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, বর্ধমান থেকেও মানুষ এই পূজোয় অংশ নেন।  

বীরভূমের লাভপুর এলাকার একটি গ্রাম সুঁদিপুর। এই গ্রামে বাস করেন প্রায় ১২০ ঘর আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। এ গ্রামেও বেশ কয়েক বছর ধরে দুর্গাপুজো করেন সুঁদিপুর গ্রামের কোঁড়া পরিবারের সদস্যরা। তবে সেই পুজো হয়ে থাকে ব্রাহ্মণ ছাড়াই। দুর্গা পুজো হলেও প্রথাগত দেবী আরাধনা নয়, নিজেদের মতো করেই বংশ পরম্পরায় দুর্গাপুজো করে আসছেন সুঁদিপুর গ্রামের কোঁড়া পরিবারের সদস্যরা। তবে পুজোয় সামিল হন গোটা গ্রামের মানুষ। পুজো উপলক্ষে চার দিনের জন্য পৈতে ধারণ করে আরাধনা করেন ওই পরিবারের পুরুষ প্রতিনিধি।এক সময় আশপাশের অনেক গ্রামে পুজো হলেও তাতে অংশ নেওয়ার অধিকার ছিল না সুঁদিপুর গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের। দূর থেকে দুর্গা প্রতিমা দর্শন করে ফিরে আসতে হতো তাঁদের। শুধুমাত্র দশমীর দিন ঘট বিসর্জনের সময় আদিবাসীরা ধামসা-মাদল নিয়ে নাচ দেখানোর জন্য ডাক পেতেন। কিন্তু তাঁদেরও ইচ্ছে হয় নিজেদের মতো করে পুজোর আনন্দ পেতে। প্রায় ৭০ বছর আগে পুজোর পরিকল্পনা করেন কোঁড়া পরিবারের পূর্বপুরুষ প্রয়াত গোকুল কোঁড়া। প্রথম পুজো হয়েছিল ঘট পেতে। কিন্তু সেদিন ব্রাহ্মণ বা পুরোহিতরা আদিবাসীদের পুজো করতে রাজি হননি। তখন কোঁড়া পরিবারের সদস্য পৈতে পরে এই পুজো করেছিলেন। তারপর থেকে সেই ধারাই চলে আসছে। ষষ্ঠীর দিন পৈতে ধারণ করে কোঁড়া পরিবারের সদস্য পুরোহিত হন। দশমী পর্যন্ত সেই পৈতে নিয়ে আদিবাসী মন্ত্রে পুজো হয়। দশমীর দিন ওই পৈতে খুলে রাখা হয় দেবীর কাঠামোতে এবং পরের বছর বোধনে বিসর্জন করা হয়।’ 

প্রায় একশো বছর আগের কথা। দেশ তখন ব্রিটিশদের কবলে। অবিভক্ত বাংলার বীরভূমের রামপুরহাট এলাকার একটি অখ্যাত গ্রাম সুলুঙ্গায় ১৯২৮ সালে শুরু হয়েছিল দুর্গা পুজো। গ্রামটি এখন বীরভূম আর ঝাড়খণ্ড সীমানার গা ঘেঁষে রামপুরহাট ১ নম্বর ব্লকে। এই গ্রামে দুর্গাপুজো শুরু হওয়ার এক ইতিহাস আছে। কৃষি প্রধান এই গ্রাম ছিল বৃষ্টি নির্ভর। গ্রামের পাশে ছিল একটি মাত্র কাঁদর (ঝাড়খণ্ড ও লাগোয়া মানুষদের কথ্য ভাষায় পাহাড়ের গুহা বা বড় কোনও গর্ত)। সেখানে বাঁধের মতো জল ধরে রাখতে পারলে চাষের সুবিধা হয়। বৃষ্টির জন্য নির্ভর করতে হয় না। ওই এলাকাতেও একটি কাঁদর রয়েছে, যার স্থানীয় নাম ভুটকা কাঁদর। এখানে জল ধরে পরে চাষ করার ভাবনা নিয়ে ভুটকা কাঁদরে একটি বাঁধ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন ব্রজ মুর্মু ও দুর্গা মুর্মু। সেই মতো ১৯২৫ সালে বাঁধ নির্মাণের আবেদন জানিয়ে চিঠি পাঠানো হয় তৎকালীন সিউড়ি কালেক্টর অফিসে। কিন্তু বারবার আবেদনেও ইংরেজরা সাড়া দেয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজেরাই নুড়ি-পাথর এবং চুন-সুরকি দিয়ে বাঁধ তৈরি করেন তাঁরা। কথিত, মা দুর্গার কাছে শপথ নেওয়া হয়েছিল, দেশ থেকে ব্রিটিশদের তাড়াতে পারলে সাদা পাঁঠা বলি দেওয়া হবে। সেই থেকে শুরু হয় পুজো। তারপর থেকে অষ্টমীর দিন সাদা পাঁঠা বলি দেওয়ার চল। কেউ মানত করলে বলির সংখ্যা বাড়ে। সুলুঙ্গা গ্রামের ১১৮টি পরিবারের মধ্যে অধিকাংশই আদিবাসী। তাঁদের কেউ কেউ এখন খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী হয়েছেন। তবে সুলুঙ্গা গ্রামের পুজোর পুরোহিত আদিবাসী। আদিবাসী রীতি মেনে আদিবাসী ভাষার মন্ত্রোচ্চারণেই পুজো হয়।