পঞ্চমপর্ব
প্রায় সারা দিন জাহাজের স্পিকারে খুব সুন্দর বাঙলা বা হিন্দিতে পুরানো গান বাজানো হয়। তবে বাঙলা গানের উপর রয়েছে বেশ খানিকটা পক্ষপাতিত্ব। অধিকাংশ যাত্রী এবং জাহাজের কর্মী বাঙালী, হয়তো তাই। বুঝলাম প্রথম দিন রাতে যে সেতারের সুর কানে এসেছিল তার উৎস ছিল জাহাজের এই স্পিকার।
সন্ধ্যার পর জাহাজ সেজে উঠেছে আলোর মালায়। যদিও এই মাঝ সমুদ্রে তার রূপ দেখার নেই কেউ। স্পিকারে বাজছে রবীন্দ্র সংগীত। একটু পরে ওই স্পিকারের ঘোষণায় জানলাম সিনেমা দেখানো হবে পেছনের চাতালে। কমলদা দের সঙ্গে ছুটলাম সেখানে। দেখলাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে ২০-২৫ জন বসে, একটা ছোট পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানোর তোড়জোড় চলছে। সিনেমার কথা স্পষ্ট মনে রয়েছে, আমরা সেদিন দেখেছিলাম, ‘কিঙ কঙ’। ওখানেই আলাপ হলো এক বাঙালী অফিসারের সঙ্গে তিনি এই জাহাজের ‘জন সংযোগ অফিসার’ (PRO)। জানালেন প্রায় ৫ দিনের সমুদ্র যাত্রার একঘেয়েমি কাটাতে মাঝে মাঝেই সিনেমার আয়োজন করা হয়। জাহাজে রয়েছে একটা ছোট্ট লাইব্রেরী, চাইলে সেখানে বসে বই পড়তে পারেন। এছাড়া রয়েছে ছোট একটা রিক্রিয়েশন রুম,সেখানে হারমনিয়াম, ডুগিতবলা, খোল ও আরও কিছু বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। ইচ্ছে হলে সেখানে বসে গান বাজনা করতে পারেন। অবসর সময়ে সে গান’বাজনা জাহাজের স্পিকারের সঙ্গে সংযোগ করা যায়। একথা জেনে কল্যাণীর সবাই খুব খুশী। কারণ ওদের দু’জন রীতিমতো গান বাজনা করেন।
পরেরদিন কমলদা দের সঙ্গে বসে গেলাম গান বাজনার আসরে, আন্য দু’চার জন সঙ্গীও গেল জুটে। কল্যাণীর ওই বিএড ছাত্রদের মধ্যে একজন তো রিতীমত দক্ষ গণসংগীত গায়ক। ওঁর গলায়, ‘নাম তার ছিল জন হেনরী’ এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। আমিও ওদের দলে খুব একটা বেমানান ছিলাম না। সেসময় গলা কাঁপিয়ে অনেক কবিতা মুখস্থ বলতে পারতাম। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত, সুনীল গাঙ্গুলি এমনকি নাজিম হিকমতের অনেক কবিতা আমার কণ্ঠস্থ ছিল। জাহাজের স্পিকারে আমাদের গানের সংযোগ হওয়ায় আমরা তো তখন রিতীমত বিখ্যাত। আমাদের এই গানবাজনা আন্দামানেও আমাদের যথেষ্ট খাতির বাড়িয়ে দিয়েছিল। সে গল্প পরে।
আমার চেয়ে একটু বড়, সুন্দর চেহারার একজনের সঙ্গে আলাপ হলো, সেও একা একাই আন্দামান যাচ্ছে। তবে এর আগেও ঘুরে এসেছে ওখান থেকে। আন্দামানে ওর দিদি চাকরি করেন, তার ট্রান্সফার হয়ে গেছে। সেকারণে ও এসেছে দিদিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। ওর দিদি কাজ করেন এখানকার ‘Anthropological Museum’ -এ। পরে সে কারণে আন্দামানে এসে খুব ভালো করে এখানকার Anthropological Museum দেখার সুযোগ ঘটেছিল। সেসময় এই Museum এখানকার এক অন্যতম সম্পদ ছিল। বিভিন্ন উপজাতি দের নিয়ে কাজ করা অনেক গবেষকও এখানে ছিলেন। তাঁদের কাছে অনেক রোমাঞ্চকর গল্পও শুনেছি। আর ‘জারোয়া’,’ওঙ্গি’ ‘স্যান্টিনেলিস’ এসব আদিম উপজাতিদের নিয়ে খুব সুন্দর একটা Documentary ছবি দেখেছিলাম মনে আছে। আমার এই নতুন জাহাজী বন্ধুর নাম এখন আর স্মরণে নেই, তবে এটা মনে আছে ওর বাবা নাকি তখন ছিলেন বর্ধমান জেলার ‘এ ডি এম’।
বিকেলে এই বন্ধুর সঙ্গে জীবনে প্রথম আমার ‘মদেখড়ি’ হয়েছিল ওই জাহাজেই। ‘মদ’ মানে ‘বিয়ার’। জাহাজে ডাইনিং হলের কাছে ছিল একটা ছোটখাটো ‘বার’। বার বস্তুটিকে এর আগে সিনেমা ছাড়া কোথাও দেখিনি, তাও সেটাকে যে বার বলে সেটাও প্রথম জানলাম জাহাজে এসে। বিয়ারের দামটা এখনো পষ্ট মনে আছে,১১ টাকা। মদ ব্যাপারটাই তখন ভাবতে পারতাম না, তাও আবার ১১টাকা? আমার ওই নতুন জাহাজী বন্ধু বোধহয় বেশ অভ্যস্ত। আমার আপত্তি না শুনে দু’ বোতল বিয়ার নিয়ে এল, আমি এও ভাবতে পারছিলাম না দু’বোতল মদ এক সিটিং এ খাওয়া যায় বলে। আমি মেরেকেটে চোখ-নাক বুজে সিকি গ্লাস বিয়ার খুব কষ্ট করে গিলেছিলাম। বাদবাকি সবটাই খেয়েছিল ওই বন্ধুটি। সেটাও আমার কাছে ছিল চরম বিষ্ময়কর, আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে, এ কতবড় প্রতিভা? যে দু বোতল মদ একসঙ্গে খেয়ে নিতে পারে। পরে জাহাজের ডেকে নিরিবিলিতে বসে বুঝতে পারছিলাম ওই সিকি গ্লাস বিয়ার খেয়ে আমি অসংলগ্ন বকছি কিন্তু দু বোতল খেয়েও আমার সঙ্গী নির্বিকার। এ বিষ্ময় ছিল আমার দীর্ঘদিন।
সেসময় ওই জাহাজে আমার ব্যাঙ্কের উল্টো দিকের সাউথ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলির কর্তাটিও আমাকে খুব বিস্মিত করেছিলেন। সারাদিনই প্রায় লোকটা তারই মতো কয়েকজন জুটিয়ে জুয়া খেলে, মদ গাঁজা খায়, সঙ্গে আনা ভাত খেয়েই কাটিয়ে দিল প্রায় ৫টা দিন। লটবহর, পোশাক আশাক সবই অত্যন্ত জীর্ণ ও নোংরা। কিন্তু লোকটার সঙ্গে রয়েছে খুব যত্নে রাখা অনেকগুলো এলবাম, তার সবকটিতেই দেশের বা দেশের বাইরের প্রায় সমস্ত ভি আই পির ছবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ওই লোকটা। তখন তো ফটোসপ ছিলো না, তাহলে কি করে সম্ভব দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, জনপ্রিয় অভিনেতা, বিদেশি অতিথি, বিখ্যাত বাবাজী কে নেই সেখানে? সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দাঁড়িয়ে বা বসে আমার উল্টো দিকের সহযাত্রী ওই সাধারণ লোকটি। প্রতিটি ছবিই খুব প্রফেশনাল হাতে তোলা। তখনকার ওই অপরিণত বুদ্ধিতেও বুঝতে পারছিলাম এটা বাস্তব নয়, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না এটা যোগাড় করা সম্ভব হলো কি ভাবে। লোকটি নাকি জ্যোতিষী এবং চিকিৎসক। বিভিন্ন জড়িবুটি, মাদুলি তাবিজ দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য ও ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়। যদিও নিজের ভাগ্যের দিকে একটুও নজর দেয়নি।
চলবে