এক নজরে

ব্যতিক্রমেরও ব্যতিক্রমঃ সাকিনা

By admin

March 09, 2024

(গত সংখ্যার পর)

রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পরে কলকাতার নিম্নতম শ্রেণির সঙ্গে সাকিনার পরিচয় গভীর হয়। শেষে ইনি কলকাতা পুরসভার মজদুর ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়া। মঞ্জু চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ১৯৪০ সালের পুরসভার নির্বাচনের আগে ধাঙ্গর ছাড়া অন্যান্য কর্মীদের মাইনে বাড়ায় অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল। ১৯৪০-এর ২৪ মার্চ থেকে পুরসভার অস্থায়ী কর্মী ধাঙ্গররা যুদ্ধের বাজারে মাইনে বৃদ্ধি-সহ বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে ধর্মঘট ডাকেন। এই ধর্মঘটে সাকিনা অবিংসবাদী নেতা হয়ে যান। এই ধর্মঘট কদিন চলার পরে আংশিক সাফল্য আসে। তিরিশ টাকা অবধি মাইনে যাঁদের তাঁদের ১ টাকা ডিএ দেওয়ার দাবি মেনে নেওয়া হয়। এরপর ২ এপ্রিল ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। সাকিনার বাড়িতে তৈরি হয় ইউনাইটেড ক্যালকাটা কর্পোরেশন ওয়ার্কাস ইউনিয়ন। শ্রমিকরা তাঁকে ভালবেসে মাতাজি বলে ডাকত। মঞ্জু লিখেছেন, Sakina had achieved a complete identification with the scavengers. She paid constant visit to their slums and was always surrounded by hundreds of workers. They came freely to her house at Middle Road and many of them slept in her house. The Union Office of the scavengers was also in her house and Sakina worked feverishly to advance their cause, কিন্তু এর পরে পুরসভা কর্তৃপক্ষ তাঁদের কথা না রাখলে ধাঙ্গররা আবার ক্ষেপে যায় (ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কারণ, এর আগেও ১৯২৮ সালের ধাঙ্গর আন্দোলনের সময়ও পুরসভার ভদ্রলোকরা ঠিক এই কাজ করেছে) এবং ২৬ আগস্ট ফের ধর্মঘট ডাকে। ইতিমধ্যে বোস-লীগ প্যাক্ট হয়েছে, এবং সুভাষের সমর্থনে লীগ ক্ষমতায় এসেছে। সিদ্দিকির নেতৃত্বে লীগ মন্ত্রিসভা পুলিশের সাহায্য নিয়ে লাঠি-গুলি চালিয়ে, সাকিনা সহ বহু ধর্মঘটীকে আটক করে ও অবেশেষে ৫ সেপ্টেম্বর এই ধর্মঘট বানচাল হয়ে যায়। পরে সাকিনাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে কারশিয়াং-এ নির্বাসন দেওয়া হয়।

কেউ কেউ বলেছেন তিনি আর কলকাতায় ফেরেননি। কিন্তু তারও সত্যতা নিয়ে আমি নিঃসন্দেহ নই। একটা জিনিস কিন্তু খুব পরিষ্কার যে সাকিনা আগে যতই দেশের মেয়েদের উন্নতি নিয়ে ভাবুন না কেন, এই আন্দোলনে কিন্তু নারীকেন্দ্রিক দাবি দাওয়া তেমন একটা কিছু উঠে আসেনি। তাহলে কি তিনিও ভাবতেন যে পরিবারের হিত আর্থিক সমৃদ্ধিতে আর তাতেই নারীরও হিত? নাকি ভেবেছেন আগে পরিবার স্থিত হলে তারপর মেয়েদের অবস্থার উন্নতি করা যাবে? ইতিমধ্যে ঘোর যুদ্ধ বেঁধে যায়। কলকাতার আকাশে মুহুর্মুহু বোমারু বিমানের সাইরেনের শব্দ শোনা যায়। কলকাতা ছেড়ে দলে দলে লোকে পালাতে থাকে। সাকিনাদের নতুন ইউনিয়নও মুখ থুবড়ে পরে। ১৯৪১ সালে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যালিটি(এমেন্ডমেন্ট)বিল, ১৯৪০-এর প্রতিবাদে ৯ ও ১০ জানুয়ারী টাউনহলে যে সভা হয় তার দ্বিতীয় দিনে বেগম সাকিনা এই বিলের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। তবে প্রত্যক্ষ আন্দোলন-কেন্দ্রিক রাজনীতি বোধহয় এরপর থেকে তিনি ত্যাগ করেন। এরপরও এখানে ওখানে তার নাম ভেসে উঠলেও, যেমন ১৯৪৫-৪৬ সাল নাগাদ ইরান সোসাইটিতে ইন্দো-ইরান সম্পর্কের উপর তিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন বা ১৯৫০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সদস্য পদে বৃত হচ্ছেন, মূল রাজনীতির প্রাঙ্গনে আর তাঁর নাম চোখে পড়ে না।

প্রশ্ন থেকে যায় তাঁর দিদি-সহ সে আমলের অধিকাংশ অভিজাত মেয়ে যেভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে থেকে মেয়েদের নিয়ে কাজ করেছিলেন, সাকিনার জীবন সেখান থেকে এতটা আলাদা হল কেন? সেকি সেই সময়ের অস্থির কলকাতায় থাকার ফল? তাই বা বলি কেন? কত কত কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবি তো সেদিনও ঠিক আজকের আমাদেরই মতো কেউ বা শাসকের পদলেহন করেছেন, আবার কেউ বা নিজেদের আলাপ আলোচনায় শাসকের আদ্যশ্রাদ্ধ করলেও তারপর তথাকথিত নিরাপদ প্রতিবাদের রাস্তা বেছে নিয়ে পারফেক্ট সাংসারিক ব্যালান্সের পরিচয় দেন। কেন সাকিনা সেটা পারলেন না? সাকিনার লেখাপত্র পড়ার সুযোগ হয়নি এখনও, মোহাম্মদী বা সওগাতের পাতায় তাঁর লেখাসমূহ থেকে হয়ত বা তাঁর মনোভাবের একটা সামান্য পরিচয় মিলত অথবা পাইনি তার মুসলিম মেয়েদের জন্য বানানো সংগঠনের কোন বিশদ বিবরণও। সাকিনা বেগমের নামে প্রাক স্বাধীনতা যুগে লেখা একটি দুটি লেখা ইন্টারনেটে মেলে, কিন্তু ভাষার ব্যবধান তাও খুঁটিয়ে দেখতে দেয়নি। ফলে মানুষটিকে বোঝার মতন মাল মশলার বড়ই অমিল।

শুধু ঘটনা দিয়ে কি আর একটি মানুষকে বোঝা যায়? তবে এই আবছা চেনায় কেমন মনে হচ্ছে মানুষটি এক শুদ্ধ ভাবাবেগের দুনিয়ায় বাস করতেন। একটা আদর্শ মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। সম্ভবত যে মেয়েরা তাঁদের বাড়ন্ত বয়সে কেবল সৎ, মহৎ সাহিত্য পড়ে বড় হন, বাইরের জগতের সংশ্রব ছাড়াই, তাঁরা আদর্শকে বাস্তব দিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে গ্রহণ-বর্জন করার সুযোগ পান কম। মার্গারেট নোবলের জীবনেও এমন একটা ভাব দেখা যায়। তিনি প্রথম জীবনে খনি শ্রমিকদের নিজের কাজের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আর সেখান থেকে এসে পড়লেন ভারতীয় হিন্দু মেয়েদের উদ্ধার করতে। দলিত নিপীড়িতদের দুঃখে এঁদের ভয়ানক প্রাণ কাঁদে। তাঁদের হিতসাধনকেই নিজেদের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে দেখেন। হয়ত সাকিনাও একই ধাতুতে গড়া ছিলেন। সাকিনার ট্র্যাজেডি ছিল যে তাঁর এত গুণ অথচ তিনি কোন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়তে পারেননি। হয়ত কম্যুনিস্ট পার্টির লোক হলে বীরেন রায় বা সোমনাথ লাহিড়ীর মতন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা হয়ে উঠতেন পরের সময়ে। কিন্তু তাহলে আবার অত স্বল্প সময়ে কলকাতার প্রায় সকল মেথরদের ভরসার ‘মাতাজি’ হয়ে উঠতে পারতেন কি? কী হলে কী হতে পারত সবটাই অবশ্য স্পেকুলেশন। অবশ্য কেন-ই বা কোন দলের সঙ্গে জুড়ে যেতে পারেননি তাও বোঝা যায় না। তুমুল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধ? নাকি কারোরই সব বক্তব্য ভাল না লাগা, নিজের ভাবনার সঙ্গে না মেলা আর ১০০% না মিললে সেখানে নিজেকে মেলাতে না পারা? সেই আমলের আরও দু চার জন ট্রেড ইউনিয়নিস্ট মেয়ে নেতারও কিন্তু এই সমস্যা ছিল। তবে কি ছেলেদের বিশ্বদর্শনের সঙ্গে প্রথম যুগের সদ্য অন্তঃপুর থেকে বেরোনো মেয়েদের দেখার কোন তফাৎ ছিল, যে তফাৎ পরের সময়ে ক্রমাগত বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচয়ের দরুণ এবং চারপাশের পুরুষ প্রাধান্যের কারণে তাঁদের ভাবনার ধাঁচটাই আরও বেশি করে মেয়েদের উপর চেপে বসে ধীরে ধীরে ঘুচে গেছে?

সে সময়ের মেয়েদের মোটিভেশনেরও তফাৎ ছিল কি? তবে দিনের শেষে যে সত্যিটা হাতে রয়ে যায় যে সাকিনাকে আমরা ভুলে গেছি। তাঁকে স্মরণে রাখানোর জন্য কোনো সংগঠন ছিল না। তাঁর পারস্যাগত বাবার পরিচিতিও তাঁর ভারতীয় হিসেবে গৃহীত হওয়ার পক্ষে সুবিধার না। সে যতই তাঁর কলকাতায় জন্ম হোক না কেন। তিনি নিজেকে কি হিসেবে ভাবতে ভালবাসতেন? জানা নেই। তবে হাবল-এল-মাতিন নিয়ে সামান্য যেটুকু ইংরাজি ভাষার আলোচনা পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে যে তাঁর বাবা সম্ভবত প্যান-ইসলামিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। বাবা-মেয়ে কি একই পথের পথিক ছিলেন? জানি না। জানার উপায় পাইনি। এদিকে বাংলায় বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানদের ক্রমঃউত্থানের ফলে বাঙালি চেতনাও বেশ জাঁকিয়ে বসে। সেখানে আর বিদেশী ফার্সি পন্ডিতের কতই বা দাম থাকে? যে বড় আপসোস হয়! কেন যে সাকিনা একটা আত্মকথা লিখে গেলেন না! অন্তত মেয়েদের চোখে কলকাতা হাইকোর্টের অন্দরমহলের কথাও যদি একটু লিখে রেখে যেতেন! কেমন ছিল তাঁর কেরিয়ারগ্রাফ? কেন তিনি রাজনীতিতে জড়ালেন? ছোট থেকে পর্দা মেনে চলা মেয়েটির, বেপর্দা হয়ে ময়দানে হাজারো মানুষের সামনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে ঠিক কি মনে হত? কিভাবে তিনি এই পর্দার বাইরে বেরোনোর সময়ের আত্ম-দ্বন্ধের মোকাবিলা করেছেন? আর নাহয় একরকম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে জড়ানো তখনকার উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ফ্যাশন-ই ছিল, কিন্তু তারও তো একটা বাধা গন্ডি ছিল। উনি কেনই বা সেই লক্ষ্মণের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে, নিজের আজন্ম লালিত এলিট পরিচয়ের বাঁধন ঘুচিয়ে আচমকা ধাঙ্গরদের সঙ্গে নিজেকে জড়ালেন?

হাইকোর্টে তাঁর সহকর্মীদের কাছে এ নিয়ে জবাবদিহি করতে হয়েছে কখনো? নাকি লিঙ্গগত ভিন্নতার কারণে সামাজিক আলাপ-প্রত্যালাপ করার মতন কোন সহকর্মীই তাঁর তৈরি হয়নি? সেই ফাঁক ভরতেই কি মাতাজি ডাকের অন্তরঙ্গতা বেছে নিয়েছিলেন তিনি? আবার কেনই বা ছেড়ে দিলেন? যে তুলনামূলক চেনা গতের বৃত্তে তাঁর বাকি বোনেদের জীবন ঘুরেছে, তার থেকে এতটা আলাদা তাঁর জীবন, তাতে কোনো ব্যক্তিগত বৃত্তে সমস্যা হয়নি? কিভাবে তিনি ব্যক্তিগত জীবনে তজ্জনিত সমস্যা বা বিতর্কের সমাধান করতেন? তাঁর কাজ তাঁর পরিবার কি মেনে নিয়েছিল? নাকি তাঁকে মানসিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল? কিভাবে সকল বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলেন তিনি? বইয়ের দুনিয়ায় ডুবে থেকে? যে সময়ে আশেপাশের সব মেয়েদের মাতৃ পরিচয়ই একমাত্র পরিচয়, সেখানে তাঁর কন্যাটিই বা সেই সময়ে বসে কিভাবে মেনে নিয়েছিল মায়ের এই ভিন্ন রকমের ভাবমুর্তি? সব থেকে বড় প্রশ্ন যে বহুবিধ সুতোর টানাপোড়েনে একজন মানুষের আইডেন্টিটি গড়ে ওঠে, তার মধ্যে কোনটা কোনটা সাকিনার নিজের চোখে গুরুত্বপুর্ণ আর কোনটা কোনটাকে তিনি কার্পেটের আড়ালে ঠেলে রাখতে বাধ্য হতেন? বাইরের দুনিয়া তাঁকে যে চোখে চেনে আর নিজেকে তিনি যে চোখে দেখেন তার মধ্যে কত ডিগ্রির তফাৎ? কেমন করেই বা তিনি বাকি জীবন কাটালেন? প্রশ্ন অনেক, কেই বা উত্তর দেবে! সাকিনার অন্তরমহলটি প্রহেলিকাই হয়ে থাকে!

(শেষ)