এক নজরে

বন্ধু চল

By admin

December 23, 2022

তৃতীয় পর্ব

শীত পড়লেই, তাক থেকে লেপ-বালিশ-তোশক নামলেই, গুটি গুটি পায়ে বড়দিন এগিয়ে এলে নবনীতা দেবসেনের সেই কয়েকটা লাইন বার বার ফিরে আসে৷ আধঘণ্টার জন্য পৃথিবীতে আর সব অক্ষর ফুরাক৷ ‘ভালবাসা’ এই চতুষ্পদে বর্ণমালা শেষ হয়ে যাক৷’ এই লাইনগুলি দেওয়ালে দেওয়ালে ঝুলতে থাকে একটাই কারণে, এই ডিসেম্বরের মাঝামাঝিই তো সেই অমোঘ রাত্রি এসেছিল৷ যে রাত্রিতে সেই নৈঃশব্দ্য এসেছিল৷ গভীর রাতে সিলিং থেকে একটা দড়ি এসে ‘ভালবাসা’-র গলায় চেপে বসেছিল৷ প্রশ্ন করো, কেন বা এমন হয়? কেন নিকষ রাতের আজান? বাউলরা বলেছিল, আপনাকে(নিজেকে)জানতে হবে৷ আপনাকে জানা মানে নিজের দেহকে জানা৷ অথচ ডিসেম্বরের রাতে উদোম হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই সেই ‘ভালবাসা’ নামে দৈত্যটা এসে সামনে দাঁড়ায়৷ পোশাক পরতে দেয় না৷ পোশাক পরে ফেললেই রাগে গরগর করতে করতে ‘ভালবাসা’ ছেড়ে চলে যায়৷ এই ডিসেম্বরেই তো শিরস্ত্রাণ খুলে রেখে রণক্লান্ত সেনা হয়ে শোকে মুহ্যমান বসে থাকা৷

আসলে বেশিরভাগ সময়ই আমরা নিজেকে গভীরভাবে না বুঝেই বন্ধুর ‘ভালবাসা’কে বুঝতে যাই৷ অনিবার্যভাবে সেখানেই ঘটে বিপত্তি৷ লালন বলছে, নিজেকে গভীরভাবে ভিতরে-বাহিরে জানতে হবে, তবেই অপরের হৃদয়ের গভীর হৃদয়ে হাত রাখতে পারবে, সেখানে ফুটে আছে কোনও গোলাপ৷ ডিসেম্বরের এই সময়টাতেই তো আলো ঝলমলে পার্কস্ট্রিটে সেই বন্ধুকে দেখতে পাই৷ যার রক্তে, মাংসে, হাড়ে, মজ্জায় কাশফুলের দুলে ওঠা হাওয়া৷

পার্কস্ট্রিটের এত এত আলোর রোশনাই তো রাত্রিগুলিকে মুছে দিতে পারে না৷ ভুলিয়ে দিতে পারে না ২৫ বছরের সেই মেয়েটির সকরুণ বিস্মিত করা দৃষ্টি৷ আর সেই দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা অনবরত ‘ভালবাসা’র কানামাছি খেলে যাচ্ছি দিব্যি৷ পাঁচ ফুট বাহুর ভাঁজে আতিপাতি করে খুঁজে বেড়াচ্ছি সেই ‘ভালবাসা’র বন্ধুটিকে৷ এই ডিসেম্বরেই তো মাঝরাতের পার্কস্ট্রিটের মাদকতা ছেড়ে চুপি চুপি আস্তাবলে ঢুকে পড়ার সাহস ধরে প্রাণ৷ সবচেয়ে তন্বি ঘোড়াটার পিঠে চড়ে বসি৷ তার ক্ষুরেও লেগে যায় নেশা৷ ‘ভালবাসা’ নাম দিয়ে পাঁচিলের পর পাঁচিল টপকে ফেলে আসা ক্লান্তি ভুলতে চাই৷ আবছা আলোয় ‘ভালবাসা’-র সঙ্গম দৃশ্য অপটু নয়নে দেখে সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটি৷ ডিসেম্বরের এই আলোর অধিকার তো তারও ছিল৷ কতদিনের আনন্দ আকণ্ঠ পান করে ভোর হলে আবার সেই একাকিত্বের বিশ্রাম৷ মনে মনে বিষম প্রস্ত্ততি৷ নতুন বছরে সব নতুন করে৷ অবশেষে মাঝরাতে সব আনন্দ, স্মৃতি ঘুমিয়ে পড়লে দরজা খুলে অপেক্ষায় থাকি সেই তন্বি ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শোনার জন্য৷

নতুন বছরের সামনে দাঁড়িয়ে পুরনো ‘ভালবাসা’র ছায়া বড় হতে হতে আমাদের গিলে ফেলেছে হয়ত৷ সেই সুখ স্মৃতিগুলি, সেই ‘সব কথা’ মুহূর্তের ফাঁকে ফাঁকে এমনই হয়তো সম্পৃক্ত হয়ে যায় ক্যালেন্ডার বদলে গেলেও বদলায় না কিছু৷ বরং খানা, খন্দ, গর্ত, ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আরও গভীর হয় সেই সময়গুলি৷ অথচ বাবা বলেছিলেন, ছায়াকে বড় হতে হয় নিজের থেকে, যাতে অন্য কাউকে ছঁুয়ে ফেলে সেই ছায়া৷ সেই ২৫ বছরের বন্ধুটি একদিন নিজেই বলল, মনের বেড়া শক্ত করে বাঁধো, ডুবসাগরে ডুবলে তবেই পাবে আমায়৷ এই ডিসেম্বরের এই সময়টাতে পার্কস্ট্রিটের ভিড়েই হঠাৎ তার ডাক শুনলাম৷ বুঝতে পারলাম না ভাল সময় এল, নাকি চলে যাওয়ার সময় এল৷ আধঘণ্টার জন্য পৃথিবীর সব অক্ষর ফুরিয়ে গিয়েছিল৷ ‘ভালবাসা’-এই চতুষ্পদে বর্ণমালা শেষ হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্ত্ত ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে আমার ছায়া আমাকে বলে দিয়েছিল, এ ডাক শুধু প্রান্তে বসে থাকা কুত্সিত কাকটার প্রতি, তার পরিচয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়৷