এক নজরে

এক নিঃশব্দ বিপ্লব

By admin

February 17, 2023

সালটা সম্ভবত ইংরেজি ১৯৬২। মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটের বাড়িতে ইউনিটের দুজনকে পাঠিয়েছেন কিংবদন্তি  পরিচালক সত্যজিৎ রায়। পথের পাঁচালির পরিচালক তাঁর সঙ্গ‌ে দেখা করতে চান৷ ‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং ‘আজ কাল পরশু’ ছবিতে মাধবীর অভিনয় ভালো লেগেছিল সত্যজিতের। ‘মহানগর’ এ আলোর চরিত্রের জন্য মাধবীই পছন্দের মুখ। একবার সামনাসামনি কথা বলা দরকার। সেইসঙ্গে লুক টেস্টটাও জরুরি।

প্রস্তাব শুনে মাধবী চাপা গলায় তাঁর মা’কে বললেন ‘আমি যাব না৷কাজটা শেষ পর্যন্ত পাব না। ওঁর আমাকে পছন্দই হবে না। ট্যাক্সি ভাড়াটাই জলে যাবে। ‘  ইউনিটের দুই ভদ্রলোক চলে যেতেই মা  মাধবীকে বোঝালেন, সত্যজিৎবাবুর মতো এক কথার মানুষ যখন ডেকেছেন, তখন অবশ্যই মাধবীর উচিৎ তাঁর সঙ্গে দেখা করা।

মা-মেয়ের কথোপকথনের মাঝেই ফিরে এলেন সত্যজিৎ রায়ের ইউনিটের ওই দুই ভদ্রলোক। একজন মানিব্যাগ থেকে কিছু টাকা বার করে মাধবীকে দিয়ে বললেন ‘ট্যাক্সিভাড়াটা রেখে দিন’৷ যারপরনাই লজ্জিত মাধবী কিছুতেই টাকাটা নেবেন না। কিন্তু দুই ভদ্রলোক কার্যত জোর করে ট্যাক্সি ভাড়ার টাকাটা মাধবীর মায়ের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন৷

নির্দিষ্ট দিনে সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে মাধবী গিয়েছেন। দরজা খুলে তাঁকে ভেতরে আহ্বান করেছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।  সেদিন হতাশই হয়েছিলেন মাধবী। তখন অভিযান ছবি কাজ চলছে। সত্যজিৎ জানালেন, আউটডোর শুটিংয়ের কাজে তাঁকে বেশ কয়েকদিনের জন্য কলকাতার বাইরে যেতে হবে, ফিরে এসে তিনি খবর দেবেন৷

মাধবী বুঝলেন এই খবর দেবার অর্থ নিশ্চয়ই নায়িকা নির্বাচন হয়ে গেছে, এ যাত্রায় আর তিনি সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে সুযোগ পেলেন না৷

বেশ কয়েকদিন পর আবার সত্যজিৎ রায়ের ইউনিটের লোক গিয়ে কড়া নাড়লেন মাধবীর বাড়ির দরজার। মাণিকবাবু ডেকেছেন মাধবী ম্যাডামকে। কালই যেন ম্যাডাম দেখা করেন মাণিকবাবুর সঙ্গে। সেইসঙ্গে ইউনিটের ভদ্রলোকটি মাধবীর হাতে দিয়ে যাতায়াতের ট্যাক্সি ভাড়াটাও। মনটা নেচে উঠল মাধবীর। 

এবারেও নিজে দরজা খুলে মাধবীকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন স্বয়ং সত্যজিৎ।

চা, জলখাবার এলো। ছবির নাম মহানগর।  স্ক্রিপ্ট পড়তে শুরু করলেন সত্যজিৎ। আত্মজীবনী ‘মাধবীকানন’ এ মাধবী লিখেছেন, ‘কোনও ছবি শুরু করার আগে সত্যজিৎবাবু প্রথমেই ছবির স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাতেন৷ প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে৷ সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা৷ এমন ভাবে স্ক্রিপ্ট পড়তেন, এত স্পষ্ট যে,চরিত্রটা বুঝে নিতে অসুবিধে হত না৷ আমরা বুঝতে পারতাম পরিচালক কী চাইছেন’৷

যাইহোক, মহানগর এর  স্ক্রিপ্ট তো শোনা হল, তখনও মাধবী বুঝতে পারছেন না সত্যিই তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ছবিতে সুযোগ পাবেন কি!

সংশয় ভাঙলেন পরিচালক স্বয়ং। মহানগর এর গোটা স্ক্রিপ্টটাই সত্যজিৎ রায় তুলে দিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়ের হাতে। এবার অভিনেত্রীর বিশ্বাস হল যে ‘মহানগর’ ছবিতে আরতির চরিত্রে অভিনয় করছেন তিনি। বাকিটা তো ইতিহাস। আরতি-র ভূমিকায় মাধবী ছিলেন সত্যজিতের নতুন আবিষ্কার। ছবিতে একসঙ্গে মধ্যবিত্ত বাঙালি গৃহবধূ আর পরিস্থিতির চাপে পড়ে সেই বধূরই চাকরি করতে যাওয়া, আটপৌরে ও পেশাদার দুই সেডেই মাধবী মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সকলে।

অনিল চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে মাধবীকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে ‘মহানগর’-এর গল্প।

চলচ্চিত্র সমালোচক থেকে দর্শক সবাই একবাক্যে বললেন ‘আরতি’-র ভূমিকায় মাধবীর দৃপ্ত অভিনয় শুধু বাংলা ছবির নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সম্পদ। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের বধূ আরতির অপটু হাতে ঠোঁটে লিপস্টিক বোলানোর মধ্যেই ঘটে গেল এক নিঃশব্দ বিপ্লব।