এক নজরে

এক টুকরো আমচরিত

By admin

June 16, 2025

বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ পেরিয়েছে ঠিকই কিন্তু আমতো এখনও ফুরোয়নি, ফুরোনোর কথাও নয়, তাই এই আষাঢ়ে আম নিয়ে আমড়াগাছি করবার ইচ্ছে হল। অবশ্যি আর কিছুদিন পর মরশুমি আম বিদায় নেবে। যদিও আম অমর ফল, আম দেয় অমৃতের আস্বাদ, আমপ্রীতি নেই এমন লোকে্র খোঁজ করা বৃথা হয়রানি- এমন ভাবনা নিয়েই এক টুকরো আমচরিত লিখতে বসা। আম্রকথার উল্লেখ সেই কোন যুগ থেকে শুরু হয়েছে তবু বারবার ফিরে এসেছে নানা ভাবে। ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ মহাকবি কালিদাসের কালজয়ী  নাটকে আমের মুকুল বর্ণিত হয়েছে প্রেমের দেবতা মদনের পঞ্চশরের একটি শর হিসেবে। চ্যুতবৃক্ষের প্রসঙ্গ তো একাধিকবার ঘুরেফিরে এসেছে  শ্রীকৃষ্ণের লীলাতে। ‘মাঘে বোল, ফাগুনে গুটি, চৈত্রে কাটিকুটি, বৈশাখে আঁটি, জ্যৈষ্ঠে দুধের বাটি’-   খনার প্রবচনের এই বাক্য ধারায় খোলসা হয়েছে  আমের মুকুল ধরা থেকে আম পাকা এবং দুধ–মিষ্টি দিয়ে আম খাওয়ার  সময়সীমা। আর নিশ্চিন্দিপুরের সলতে খাগীর আমবাগানের কথা তো কোনোদিন বাঙালি ভুলতে পারবে না-  যে বাগানে আমের কুশি কুড়িয়ে বেড়াতো দিদি দুগ্গা আর আম আঁটির ভেঁপু বানিয়ে বাজাতো ভাই অপু।  

সারা বিশ্বের প্রায় সবাই আমের ভক্ত, দু–একজন অপছন্দ করতেই পারে। তা করুক কিন্তু ইতিহাস যে আম ভক্ত অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির কথা বলে যারা আমকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে গিয়েছেন। আমার জানা সেই তালিকার সবার প্রথমে রয়েছেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। ভারত বিজয় করতে এসে তিনি আম খেয়ে এতটাই মুগ্ধ হন যে ইউরোপ ফেরার পথে তিনি আম সঙ্গে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমনটাও শোনা যায়, তিনিই আমকে ইউরোপে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ভারতে এসে আমের প্রেমে পড়েছিলেন। তিনিও চীনে ফিরে যাওয়ার সময় আম নিয়ে যান। ঐতিহাসিকেরা বলেন, দিল্লির সুলতানদের অনেকেই নিজেরা সিংহাসনে বসে আমকে রাজকীয় ফলের আসন দিয়েছিলেন। এর মধ্যে সবার আগে নাম করতে হয় আলাউদ্দিন খিলজির। তিনি আমকে রাজমহলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সমরখন্দ থেকে জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর দিল্লি দখল করে সেখানে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে বলেন, আমের লোভে নাকি বাবর হিন্দুস্তান দখল করেন। শেরশাহ সুরি নামে এক আফগান বীরের কাছে তাঁর পুত্র হুমায়ুন যুদ্ধে হেরে যান। এই যুদ্ধ হয়েছিল চোষা নামের এলাকায়। আমপ্রেমী শেরশাহ এই যুদ্ধের স্মৃতিতে এক আমের নাম রেখেছিলেন চোষা আম। অপর দিকে পরাজিত বাদশাহ হুমায়ুন কিন্তু আমবিদ্বেষী ছিলেন না। তাঁর পছন্দের আমের নাম তাঁর নামেই পরিচিত। সে আমের নাম হুমায়ুনপছন্দ।

মুঘল সম্রাট আকবরের বাগান তৈরির কারণে আম বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করে। সম্রাটরা তাদের বাগান এবং ভোজন বিলাসে আমকে অন্তর্ভুক্ত করতেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রে সম্রাটদের আম প্রীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে, রাজা-বাদশাহদের আম প্রীতি ছিল একটি সাধারণ বিষয়। মুঘল সম্রাট আকবরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিহারের দারভাঙ্গায় মস্ত একটি আম বাগান তৈরি করেছিলেন এবং তার বিখ্যাত গ্রন্থ আইন-ই-আকবরীতে আমের গুণাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। সম্রাট হুমায়ুনের উল্লেখ আগেই করেছি, তাঁর দরবারে আমির, ওমরাহ এবং সেনাপতিদের চিনামাটির পাত্রে সুগন্ধি মৃগনাভি উপহার দিয়েছিলেন এবং তাদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, এই সুগন্ধি যেমন তাদের শিবিরে ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি একদিন তার পুত্রও খ্যাতি লাভ করবে। সম্রাটদের আম প্রীতির প্রমাণ শুধুমাত্র মুঘল আমলেই সীমাবদ্ধ ছিল না, পরবর্তীকালেও এর প্রভাব দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, বাহাদুর শাহ জাফরের আমলে লাল কেল্লার ভেতরের আম বাগানটিকে “হায়াত বখশ” বলা হত।

আমচরিতে মির্জা গালিবের কথা না বললে আমচরিত অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আম ছিল ওঁর অতি প্রিয় ফল। এমনিতেই গালিব ছিলেন অতি ভোজনরসিক এক মানুশাহ। কিন্তু গরম পড়লেই কবির বন্ধুরা তাদের বাগানের সেরা আমগুলি তাঁকে পাঠাতে ভুলতেন না। আম নিয়ে গালিবের একটা বিখ্যাত গপ্প আছে। একবার মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জফর তার কয়েকজন সহচরকে সঙ্গে নিয়ে কিলা-ই-মুবারকে পায়চারি করছিলেন। সম্রাটের সঙ্গে গালিবও ছিলেন। কিলা-ই-মুবারকে মানে এখন যেটা লালকেল্লা, সেখানেই বাঘ-এ-হায়াত বকশ বা মাহতাব বাগানে ঘুরছিলেন তাঁরা। বাগানটির আম গাছগুলিতে নানা ধরণের আম ঝুলছিল। সেই বাগানের আমে শুধুই রাজা, রাজপুত্র ও হারেমর মহিলাদের অধিকার ছিল। গালিব প্রতিটি আম খুব ভালো করে খেয়াল করছে দেখে সম্রাট তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এত মন দিয়ে কি দেখছ?” গালিব করজোড়ে অত্যন্ত নম্রভাবে বললেন, “মহারাজা একজন কবি একবার বলেছিলেন প্রত্যেকটা ফলের গায়ে লেখা থাকে তা কার জন্যে তাই আমিও খুঁজছি কোন আমটার গায়ে আমার পিতামহ, আমার পিতা ও আমার নাম লেখা আছে!” একথা শুনে সম্রাট মৃদু হেসে বাগানের কিছু সেরা আম ঝুড়ি ভরে গালিবের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। একদিন গালিব তার প্রিয় বন্ধু হাকিম রাজিউদ্দিন খানের সঙ্গে নিজের বাড়ির বারান্দায় বসেছিলেন। হাকিম রাজিউদ্দিন খান আম পছন্দ করতেন না। রাস্তা দিয়ে একটি গাধা টানা গাড়ি যাচ্ছিলো। রাস্তায় এক রাশ আমের খোসা পড়েছিল। গাধাটা আমের খোসার গন্ধ শুঁকে নিজের মুখটা ফিরিয়ে নিল দেখে হাকিম সাহেব গালিবকে বললেন, “দেখেছ, গাধারাও আম পছন্দ করে না।” গালিব একটু হেসে বললেন, “সত্যিই তো গাধারাই আম পছন্দ করে না!”