পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসো নামটি ২০২২ সালের আগে প্রায় অজানা ছিল। স্বাধীনতার আগে (১৯৬০) নাম ছিল আপার ভোল্টা। ১৯৮৫ সালে নাম রাখা হয় বুরকিনা ফাসো, রাজধানী উয়াগাদুগু। আফ্রিকার অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা দু’কোটি। খরা ও দুর্ভিক্ষের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার লোক প্রতিবেশী ঘানা, আইভরি কোস্টসহ অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়। কৃষিকাজ ও গবাদিপশু পালন প্রধান জীবিকা। স্বাধীনতা পেলেও ঔপনিবেশিক শাসন ও একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে বুরকিনা ফাসো ছিল রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই চলছিল। যদিও ১৯৯১ সালে সংবিধান প্রণয়ন করে এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। প্রথম থেকেই বুরকিনা ফাসোতে ইসলামের আধিপত্য ছিল। তখন অবশ্য এটি আলাদা ভূখণ্ড ছিল না, ঘানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্ধেকের বেশি লোক মুসলমান হলেও এক-পঞ্চমাংশ ক্যাথলিক খ্রিস্টান, এক-ষষ্ঠাংশ প্রথাগত ধর্মের অনুসারী এবং বাকি লোকজন প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান। ১৯১৯ সালে বুরকিনা ফাসো ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিণত হলে মুসলমানেরা রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়ে। ষাটের দশকে ফ্রান্স দেশ ছাড়লেও ৬০ শতাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যালঘু খ্রিস্টান শাসকগোষ্ঠীর শাসনে নির্যাতিত ছিল। ফলে প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ময়দানে পিছিয়ে পড়েছিল।

২০২২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ট্রাওরে বুরকিনা ফাসোর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর ফ্রান্সের সঙ্গে ঔপনিবেশিক সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জোট গড়ে তোলেন। বদলে বুরকিনা ফাসোতে একটি রুশ প্যারামিলিটারি বাহিনী মোতায়েন করা হয়। একইসঙ্গে তার সরকার বাম ঘরানার অর্থনৈতিক নীতির পথে হাঁটা শুরু করে। এই নীতির আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত খনি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়— সে দেশে ব্যবসা করতে হলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান সরকারকে ১৫ শতাংশ অংশীদারত্ব দেবে। কেবল তাই নয়, তাদের প্রযুক্তি ও দক্ষতা শেখাতে হবে, যাতে দেশের লোকজন নিজেরাই একদিন সবকিছু পরিচালনা করতে পারে। এই নিয়ম রুশ খনি প্রতিষ্ঠান নর্ডগোল্ডের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়, যাকে চলতি বছরের এপ্রিলের শেষ দিকে বুরকিনা ফাসোর স্বর্ণ খাতে নতুন বিনিয়োগের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়। এবং ট্রাওরে একে ‘বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করছেন। দেশটি এখন নিজেদের খনিজ সম্পদ থেকে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে। কার্যত বুরকিনা ফাসো সামরিক সরকার প্রথমবার নিজেদের দেশে একটি স্বর্ণ পরিশোধনাগার (রিফাইনারি) নির্মাণ করছে এবং জাতীয় স্বর্ণ মজুত গড়ে তুলছে। তবে অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক সারামা রিসোর্সেস নামে একটি কোম্পানি ২০২৪ সালের শেষ দিকে বুরকিনা ফাসোর বিরুদ্ধে একটি মামলা করে, কারণ তাদের খনিজ অনুসন্ধানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল। পাশাপাশি ট্রাওরের সরকার লন্ডনের শেয়ারবাজারভুক্ত একটি কোম্পানির মালিকানাধীন দুটি স্বর্ণ খনি জাতীয়করণ করেছে। গত মাসে জানানো হয়েছে, আরও বিদেশি মালিকানাধীন খনির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

এই র্যাডিক্যাল সংস্কারের কারণে আফ্রিকাজুড়ে ইব্রাহিম ট্রাওরের জনপ্রিয়তা ছড়িয়েছে। তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। অবশ্য অনেক ভুয় পোস্টও ছড়ানো হচ্ছে। অবশ্য সবই তাঁর বিপ্লবী ইমেজ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। প্রশ্ন, পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের কবল থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য ট্রাওরে কি সত্যি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ? ২০২৩ সালে রাশিয়া-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে তিনি আফ্রিকান নেতাদের বলেছিলেন, ‘উপনিবেশবাদীরা দড়ি টানলে আমরা যেন পুতুলের মতো না নাচি’। ভক্তরা তাঁকে বুরকিনা ফাসোরই আরেক কিংবদন্তি নেতা টমাস সাঙ্কারার সঙ্গে তুলনা করেন যিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী বিপ্লবী এবং অনেকের চোখে ‘আফ্রিকার চে গেভারা’। কিন্তু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ট্রাওরেকে ভালো চোখে দেখেন না। তিনি তাঁকে ‘স্বঘোষিত সর্বআফ্রিকানবাদী এবং নয়া উপনিবেশবাদীদের মধ্যকার জটিল এক জোটের অংশ’ হিসেবে দেখেন। মানুষের মন, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মন জয় করলেও ইব্রাহিম ট্রাওরে এখনও বুরকিনা ফাসোর কোনও নির্বাচিত নেতা নন। দেশের সেনাবাহিনীর একটি বিদ্রোহী অংশের নেতৃত্ব দিয়ে সে দেশের প্রাক্তন জান্তা শাসক দামিবাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন। অভ্যুত্থানের পর তিনি নিজেকে বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন এবং সেই সঙ্গে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং রাষ্ট্রীয় বিধি–বিধান জারি রাখার প্রতিশ্রুতি দেন।

চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুতে এক বিবৃতিতে আইএমএফ জানায়, ‘জটিল মানবিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি‘ সত্ত্বেও ২০২৫ সালে বুরকিনা ফাসোর অর্থনীতি ‘মজবুত‘ থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। তারা বলেছে, দেশীয় রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে, সরকারি বেতনের খরচ নিয়ন্ত্রণে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় বাড়াতে সরকার ‘প্রশংসনীয় অগ্রগতি‘ দেখিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে 0. ৭ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ৪.২ শতাংশ হয়। তবে দিনে ২. ১৫ ডলারের কম আয়ে জীবনযাপন করা মানুষের হার প্রায় দুই শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৯ শতাংশে। ট্রাওরের নেতৃত্বের মূল বৈশিষ্ট্য হল তাঁর গণমুখী নীতি। তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিজস্ব মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার একটি দায়িত্ব হিসাবে দেখেন। তাঁর নিজের কথায়, তিনি ‘একজন সৈনিক, জনগণের সেবক’। ট্রাওরে বারবার বলেছেন, ‘যে জাতি তার সম্পদের ওপর মালিকানা রাখতে পারে না, সে আসলে স্বাধীন নয়।’ বুরকিনা ফাসোর মূল্যবান খনিজ সম্পদ; যেমন- স্বর্ণ, ম্যাঙ্গানিজ ও ফসফেট- বহু বছর ধরে বহুজাতিক বিদেশি করপোরেশনগুলি শোষণ করে এসেছে। ট্রাওরে বিদেশি খনন চুক্তি পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে দেশীয় জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে নীতি বদল করে, খনিজ আয়ের বড় অংশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করার নীতি গ্রহণ করেছেন যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ে।

তবে ট্রাওরের নেতৃত্বকে পশ্চিমের গণমাধ্যম অনেক সময় ‘পশ্চিমাবিরোধী’ ও ‘সামরিক শাসক’ হিসেবে আখ্যায়ীত করছে। যদিও তাঁর সমর্থকরা একে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন মনে করেন। কিছু সমালোচক মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও ট্রাওরে এসব সমালোচনাকে সরাসরি মোকাবিলা না করে বলেন, ‘আমরা যে পথে হাঁটছি, তা সহজ নয়, কিন্তু এটাই আমাদের পথ।’
